হজ ইসলামের পাঁচ রোকনের একটি। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের একবার হজ্ব পালন করা ফরজ। রয়েছে হজ করার নিয়ম। হজের নিয়ম না মেনে পালন করলে যেমন কোনো সওয়াব বা লাভ হবে না। তাই হজ ফ্লাইট এর পূর্বে হজ গাইড, হজের ফরজ, হজের দোয়া, হজের ফজিলত ও তাৎপর্য জেনে যাওয়া উচিত।
হজ তিন প্রকার, যথা— ক. হজে ইফরাদ(হজের সফর শুরু করার সময় বা মিকাত থেকে যদি শুধু হজের নিয়তে ইহরাম বাঁধা এবং হজের সঙ্গে ওমরাহ আদায় না করা); খ. হজে কিরান(একই সঙ্গে হজ এবং ওমরাহর নিয়ত করে উভয়টিই পালন করে এবং হজ ও ওমরাহর জন্য একই ইহরাম বাঁধা); গ. হজে তামাত্তু(ওমরাহ করার উদ্দেশে ইহরাম বাঁধা। এই ইহরামে মক্কায় পৌঁছে ওমরাহ পালনের পর ইহরাম ভেঙে ৮ই জিলহজ সেখান থেকেই হজের ইহরাম বেঁধে হজ পালন করা)।
হজের প্রথম দিন (৮ই জিলহজ)
৮ই জিলহজ থেকে ১২ই জিলহজ। এ দিনগুলোকে ‘আইয়্যামে হজ’ বলা হয়। ৭ জিলহজ মাগরিবের পর হতে শুরু হয় ৮ জিলহজের রাত। এই রাতেই ইহরামের নিয়তে গোসল করে সেলাইকরা কাপড় খুলে ইহরামের চাদর পরিধান করবে এবং পুরুষ হাজীরা হারাম শরিফে আসবে ও তাওয়াফ করবে।
মুস্তাহাব তাওয়াফের দু’রাকয়াত নামাজ আদায় করার পর ইহরামের নিয়তে দু’রাকয়াত নফল নামাজ আদায় করতে হয়। শারীরিক অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারনে যদি তাওয়াফ করার শক্তি বা সাহস না হয়, তাহলে শুধু ইহরামের নিয়তে মাথা ঢেকে দু’রাকয়াত নফল নামাজ আদায় করবে। যদি মাকরুহ ওয়াক্ত হয়, তাহলে নামাজ ছাড়াই হজের নিয়ত করবে। অতঃপর হজের উদ্দেশ্যে ইহরামের নিয়তে মধ্যম আওয়াজে তিনবার ‘তালবিয়া’ পাঠ করবে।
মিনার দিকে যাত্রা : তালবিয়া পাঠের পর হজের ইহরাম বাঁধা অবস্থায় মক্কা মোকাররমা থেকে ৮ জিলহজের সূর্য উদয় হওয়ার পর মিনার দিকে যাত্রা শুরু করবে। এসময় অধিক পরিমাণে তালবিয়া পাঠ করবে এবং দোয়া পড়বে। মিনায় জোহর, আছর এবং ৯ জিলহজের মাগরিব, ইশা ও ফজরের নামাজ—এই মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া মুস্তাহাব এবং রাতে মিনায় অবস্থান করা সুন্নত।
হজের দ্বিতীয় দিন (৯ঈ জিলহজ)
আরাফার দিকে যাত্রা : ৯ জিলহজ ফজরের নামাজ মিনায় আদায় করে তাকবিরে তাশরিক এবং তালবিয়া পাঠ করে আরাফার ময়দানের দিকে যাত্রা শুরু করবে। রাস্তায় জিকির, ইস্তিগফার, দুরুদ শরিফ, দোয়া ও তালবিয়া পাঠ করবে। আরাফার ময়দানে (উকুফে আরাফাহ) অবস্থানের সময় হলো ‘যাওয়াল’ অর্থাত্ সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত। এজন্য যাওয়ালের পর থেকেই অবস্থান শুরু করবে। উকুফের নিয়ত করে দোয়ার জন্য হাত প্রসারিত করে বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে তালবিয়া পাঠ করবে। এরপর, রোনাজারির মাধ্যমে তওবা ইস্তিগফার করবে এবং নিজের সব গোনাহ মাফের জন্য অন্তর থেকে দোয়া করবে। এভাবে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগ পর্যন্ত জিকির ও দোয়ার মধ্যে মশগুল থাকবে।
মুজদালিফায় যাত্রা : আরাফার ময়দান হতে সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মাগরিব ও ইশার নামাজ না আদায় করে মুজদালিফার উদ্দেশে রওয়ানা করবে। মুজদালিফায় পৌঁছে একসাথে মাগরিব ও ইশার নামাজ আদায় করবে। উভয় নামাজের জন্য এক আজান এবং এক ইকামত বলবে। পথে অধিক পরিমাণে দুরুদ শরিফ, আল্লাহর জিকির ও তালবিয়া পাঠ করতে থাকবে।
মুজদালিফায় নামাজের পদ্ধতি : মুজদালিফার পৌঁছার পর ইশার নামাজের সময় হলে প্রথমে আজান দেবে এবং ইকামত বলার পর নামাজ আদায়ের নিয়তে জামাতের সঙ্গে মাগরিবের তিন রাকাত ফরজ নামাজ আদায় করবে। অতঃপর সালাম ফিরিয়ে তাকবিরে তাশরিক এবং তালবিয়া পাঠ করবে। এরপর ইকামত ব্যতীত তৎক্ষণাৎ কোনো প্রকার দেরি না করে জামাতের সঙ্গে ইশার চার রাকাত ফরজ নামাজ আদায় করবে এবং সালাম ফিরিয়ে তাকবিরে তাশরিক এবং তালবিয়া পাঠ করবে। অতঃপর মাগরিবের সুন্নত এবং ইশার সুন্নত ও বিতর নামাজ আদায় করবে। নামাজ পরবর্তি সারারাত আল্লাহর জিকির ও ইবাদতে মশগুল থাকবে। তবে অল্প সময় বিশ্রাম ও আরাম করবে।
কঙ্কর কুড়ানো : শয়তানকে মারার জন্য মুজদালিফা থেকে রাতেই কঙ্কর সংগ্রহ করা উত্তম। তবে কঙ্কর অন্য কোনো স্থান উপায়ে সংগ্রহ করা হলে কোনো অসুবিধা হবে না।
উকুফে মুজদালিফা (মুজদালিফায় অবস্থান) : যখন সুবহে সাদিক হয়ে যাবে, তখন অন্ধকারের মধ্যেই আজান দেবে এবং ফজরের সুন্নত নামাজ পড়ে ফজরের ফরজ নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করবে। সুবহে সাদিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুজদালিফায় অবস্থান শুরু হয়ে যায়। মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। উকুফে মুজদালিফার সময় হলো সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত। সুতরাং ফজরের নামাজ আদায়ের পর থেকে জিকির ও দোয়ায় মশগুল থাকবে এবং সূর্যোদয়ের আগেই মুজদালিফা থেকে মিনায় যাত্রা শুরু করবে। সূর্যোদয়ের পর বা দেরি করে মিনার দিকে যাত্রা করা সুন্নতের বরখেলাফ।
মিনায় প্রত্যাবর্তন : মুজদালিফা থেকে মিনায় ফেরার পথে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় মন-প্রাণ দিয়ে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ ও একাগ্র হবে। এভাবে পথ চলে মিনায় পৌঁছবে।
হজের তৃতীয় দিন (১০ঈ জিলহজ)
জামরায়ে আকাবায় রমি করা : মিনায় পৌঁছার পর সর্বপ্রথম ‘জামরায়ে আকাবায়’ কঙ্কর নিক্ষেপ করবে। কঙ্কর নিক্ষেপের পদ্ধতি হলো—ডান হাতের বৃদ্ধ ও শাহাদাত আঙুল দিয়ে একটি কঙ্কর ধরে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জামরার পিলারের গোড়ার দিকে কঙ্কর নিক্ষেপ করবে। পিলারের গোড়ার কিছু ওপরে নিক্ষিপ্ত হলেও কোনো ক্ষতি নেই। এতদসত্ত্বেও এর আশপাশে গোড়ার দিকে কঙ্কর নিক্ষেপ করা জরুরি। এভাবে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে।
কোরবানি : জামরাতুল আকাবায় কঙ্কর নিক্ষেপের পর কোরবানি করবে। জিলহজের ১০ তারিখেই কোরবানি করা উত্তম; তবে ১০ থেকে ১২ জিলহজের সূর্যাস্ত পর্যন্ত রাত বা দিনের যে কোনো সময় কোরবানি করা যাবে।
হলক ও কসর (মাথা মুণ্ডানো ও চুল কাটা) : কোরবানি থেকে ফারেগ হওয়ার পর পুরুষ হাজীরা তাদের মাথা মুণ্ডাবে কিংবা মাথার চুল ছোট করে ছেঁটে ফেলবে। মাথা মুণ্ডানোকে ‘হলক’ এবং চুল ছোট করে কাটাকে ‘কসর’ বলে।
হলক বা কসর করার পর ইহরামের পূর্ববর্তী কানুনগুলো পালন শেষ হয়ে যাবে, অর্থাৎ হালাল হয়ে যাবে। তবে ‘তাওয়াফে জিয়ারত’ করা পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা হালাল হবে না।
তাওয়াফে জিয়ারত : রমি, কোরবানি এবং মাথার চুল মুণ্ডানো বা ছাঁটার পর তাওয়াফে জিয়ারত করবে। তাওয়াফে জিয়ারতের পর সায়ী করবে; অর্থাৎ সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে সাতবার দৌড়াবে।
তাওয়াফে জিয়ারতের গুরুত্ব : স্মরণ রাখতে হবে যে, তাওয়াফে জিয়ারত হজের রুকন বা ফরজ। কোনো অবস্থাতেই তাওয়াফে জিয়ারত ছাড়া যাবে না এবং তাওয়াফে জিয়ারতের পরিবর্তে এর বদলা করাও যাবে না; বরং শেষ জীবন পর্যন্ত তাওয়াফে জিয়ারত ফরজ হিসেবেই থেকে যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত তাওয়াফে জিয়ারত আদায় করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা হারাম থেকে যাবে।
সুতরাং যে কোনো অবস্থায় তাওয়াফে জিয়ারত সম্পন্ন করেই দেশে ফিরতে হবে। এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই যেন তাওয়াফে জিয়ারত ছুটে না যায়।
হজের চতুর্থ দিন (১১ই জিলহজ)
১১ জিলহজ জাওয়ালের পর তিন জামরাতেই সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করবে। অর্থাৎ প্রথমে জামরায়ে উলাতে সাতটি কঙ্কর, অতঃপর জামরায়ে উস্তায় সাতটি কঙ্কর এবং সর্বশেষ জামরায়ে আকাবায় সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করবে।
হজের পঞ্চম দিন (১২ই জিলহজ)
১২ জিলহজের দিন বিশেষ কাজ হলো জাওয়ালের পর তিন জামরাতে ১১ তারিখের ন্যায় সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করা। এদিন রমি করার পর ইচ্ছা হলে মিনায় থাকবে বা মক্কায় ফিরেও আসতে পারবে। যদি মক্কায় ফিরে আসার ইচ্ছা করে, তাহলে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই মিনার সীমানা থেকে বের হয়ে যাবে। এভাবেই পবিত্র হজ সম্পন্ন হবে।
মিনা থেকে ফেরার পর যতদিন মক্কায় অবস্থান করবে, ততদিনের এই অবস্থানকে গনিমত ও মূল্যবান মনে করতে হবে এবং যতটুকু সম্ভব তাওয়াফ, নামাজ, রোজা, দান-খয়রাত এবং জিকির ও তিলাওয়াতে নিজেকে মশগুল রাখবে। এছাড়া অন্যান্য নেক কাজ ও আমল বেশি বেশি করে পালন করতে থাকবে।
হজ থেকে প্রত্যাবর্তন এবং তাওয়াফে বিদা
হজ সম্পন্ন হওয়ার পর যখন মক্কা থেকে নিজ দেশে ফেরার ইচ্ছা করবে, তখন বিদায়ী তাওয়াফ করতে হবে। এটাও ওয়াজিব। বিদায়ী তাওয়াফ নফল তাওয়াফের মতোই। বিদায়ী তাওয়াফ থেকে ফারেগ হয়ে মুলতাজিমে এসে খুব বেশি করে দোয়া পড়বে, জমজমের পানি পান করবে এবং পেরেশান ও আফসোসের সঙ্গে পবিত্র মক্কা থেকে দেশের পথে রওনা হবে।
Comments 0