কুমারী মেয়েটি যেন বিধবা নারী
আরিফ মজুমদার
সজীবের স্মৃতি কিছুতেই নাবিলার মন থেকে বিলীন হতে চায়না! যখন-তখন নাবিলার মনের বাতায়নে সজীবের স্মৃতি টুকরো কালো মেঘের মতো ভেসে বেড়ায়। নিশিদিন শোকাতুর মনে সে-যে শুধু নিরবে অশ্রুবর্ষণ করে তা নয়-আজকাল রাত-বিরাতে নিঃসংকোচে হাউ মাউ করেই কেঁদে দেয়। ক্লান্ত হয়ে হঠাৎ করেই আবার কান্না যেমে যেত চায়। বুকের ভেতরে তবুও বেদনার বিজলী চমকায় তার। পাহাড় বুকে যে পরিমাণ কষ্ট ধারণ করে ঝড়নারূপে আজন্ম কেঁদে যায়, তারচে অধিক দুঃখশোকে নাবিলার ঊর্মিলতা যৈবনমাখা বুকের অতলে দিবানিশি হাহাকার তুলে। তাইতো নিজেকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিতে ইচ্ছে জাগে তার মস্তিষ্কে। আমুত্যৃ কেঁদে হলেও যেন নাবিলাকে এ জন্মে চক্ষুষ প্রমাণ দিতে হবে- সে তার প্রিয়তম সজীবের অনপেক্ষিত গুম হওয়াটা মেনে নিতে পারছে না।’কী করে মেনে নেবে! সবে মাত্র তো সে দিনের পরিচয়। তারপর মন দেওয়া নেওয়া। মান-অভিমান বিনিময়। দুচোখের কোণে অদূর দাম্পত্ত জীবনের ভালবাসার ঘর আঁকা। তার মানে এখনও বাকী ঢের..। আর সেই মানুষটি তার জীবন থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়াট সত্যিই যেন এক হৃদয়বিদারক ব্যাপার। নাবিলা যে দেশটির আলো-বাতাস পেয়ে আনন্দ-উল্লাসে গোলাপের পাঁপড়ির মতো সুবাস ছড়িয়ে সবে মাত্র বেড়ে ওঠেছে-সে দেশটির আইন-কানুন যেন তার জীবনের সাথে চরম তিরস্কার করল। তার স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে হৃদয়টাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিল। গরল-মানুষেরা নাবিলাকে আজ বুঝিয়ে দিল সরল জীবন-যাপনের জন্য তার চারপাশের পরিবেশটা মোটেই সুইটেবল নয়। নাবিলা যতোই কাঁদতে কাঁদতে ম্যানট্যালি সেন্সলেস হয়ে যাবে! তাতেই বা কার কী আসে যায়! কে দিবে এই তরুণীকে সান্ত্বনার পরশ! কী ফিরিয়ে দিবে গুম বা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া তার প্রিয়তম সজীবকে!
নাবিলার বাবা সাবের চেীধুরীর অনুরোধে নামজাদা হাসপাতালে কর্মরত ইউ.এস. এ. থেকে ডিগ্রীধারী দীর্ঘদিনের বন্ধুর সুযোগ্য পুত্র এক তরুণ মানোরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে চলছে মেয়ের চিকিৎসার অপচেষ্টা। নবিশ ডাক্তার প্রতিদিনই নিত্য-নতুন কৌশল অবলম্বন করে নাবিলাকে স্বাভাবিক পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে অনুরোধ জানায়। ডাক্তারের উপদেশ বাণী শুনে নাবিলা শুধু ফ্যল-ফ্যালিয়ে অবাক নয়নে চেয়ে থাকে। মাঝে-মধ্যে ডাক্তারকে কোমল স্বরে প্রশ্ন করে কী যেন জানতে চায়, ‘ডাক্তার কেন মিছে মিছে আমাকে স্বাভাবিক হতে পরামর্শ দিচ্ছেন? আমাকে কী আপনার কাছে এ্যবন্যরমাল বলে মনে হচ্ছে! তার মানে এ যে প্রতিনিয়ত গুম,অপহরণ সহ নারকীয় হত্যাকান্ডের খবর দৈনিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। সবই আপনাদের কাছে স্বভাবিক ঘটনাবলি বলেই মনে হচ্ছে! তবে কী আমিই অস্বাভাবিক! আমি কী শুধুই অরণ্যে-রোধন করে যাচ্ছি! আমিই ডিসব্যালেন্স! নিজের সাথে প্রতারণা করতে এইটুকুও বিবেকে বাঁধছে না, ডাক্তার! হোয়াই ডন্ট আন্ডারস্টেন্ড ইট! আমি কোন ম্যানটাল প্র্যবলেম সাফার করছি না! সো-প্লিজ,যদি পারেন-সজীব কে ফিরিয়ে নিযে আসুন। প্রয়োজনে আপনি নিজে তদ্ধন্ত করুন। আপনার মেধা শুধু শুধু আমার পিছে ব্যয় না করে একটি জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। আমি জানি ডাক্তার আপনার পক্ষে তা মোটেই সম্ভব না। তবু এই নিমিত্তে বলছি, তাকে আমি অনেক ভালবাসি, ডাক্তার। সে না হলে আমি কী করে বাঁচার স্বপ্ন দেখি! আমি যে বুকফাটা আর্তনাদে নির্ঘাত মারা যাবো। সজীব নেই তো-এই যে আমার বেঁচে থাকা তা যেন অসম্ভব হয়ে পড়ছে!..কথাগুলো বলতে গিয়ে নাবিলার বুক কেঁপে চোখের কোনে কান্না নেমে আসে। ডাক্তার অরুণের অবস্থা তখন যেন করুণ হয়ে যায়! নাবিলাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ল্যঙ্গুইজ সে তার মগজের ভান্ডারে সন্ধান করেও খুঁজে পায় না। ডাক্তার নিজের অক্ষমতা বুঝতে পেরে আবেগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আপন জলমাখা চোখের পাতা আঙুল দিয়ে মুছে নেয়। নাবিলার মতো তরুণীর শোক পালনের ভঙ্গিমা স্বচক্ষে দেখে জলজ্যন্ত স্বর্গীয় দেবী যেন বাস্তবে ধরা দেয় তার চর্ম চোখের সামনে। ডাক্তার চুপচাপ দাঁড়িয়ে সুনয়না-তরূণীকে পর্যবেক্ষণ করে। আর এদিকে তরুণীর মনের বাতায়নে তখন ভেসে ওঠে প্রিয়তম সজীবের মন জাগনিয়া-স্মৃতিগুলি-
সজীব পেশায় একটি প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকার ফটোজার্নালিস্ট। ছবি তোলা তার পেশা হলেও নেশাটাই ছিল বেশি। বয়সে তরূণ মানুষটির চোখের সামনে অনিয়ম ধরা পড়তেই ক্যামেরা বন্ধী করে নেয়। পরদিন যা দৈনিক-পত্রিকার পাতায় প্রকাশ পায়। অধিকাংশ ছবিগুলোর ভাষাই সমাজের দুর্নীতি ও দুর্রব্যবস্থার কথা বলে। পেশাগত কাজের বাইরেও শখের বশে প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে সজীব বিভিন্ন ক্যাটাগরির দৃশ্যগুলি হাতের ক্রামেরায় তোলে নিতে কভু ভুল করে না। কখনো পাখি জোড়ার দৃশ্য, কখনো বা যুবতী মেয়ের রুপ মার্ধুয্যভরা রহস্যময়ী মুখখানা। কিবা খেটে খাওয়া মানুষদের কর্মচিত্র, কখনো বনোফুল, কখনো বা গোধূলীবেলায় দূরের আকাশে অস্থে যাওয়া সূর্যের মায়া ছড়ানো দৃশ্য, গ্রাম্য জীবনের সরলতা,শহুরে লাইফের ব্যস্থতা এই সবই যেন ফুটে ওঠো সজীবের আলোকচিত্রে।
বিগত দুবছর ধরে সজিবের তোলা ছবিগুলো থেকে বাছাই করা সেরা পঁচিশ -ত্রিশটি ছবির এক্সিভিশন চলছে নগরের অভিজাত এলাকা গুলশানের একটি বিখ্যাত গ্যালরীতে গতকাল উইক-এন্ডে থেকে। ভার্সিটির বান্ধবী নুশরাত সহ প্রদর্শনীতে ছবি দেখতে এসে একটি ছবির প্রতি নাবিলার মোহ জন্মে । নাবিলা ছবিটি তার কালেকশনে রাখতে এদিক সেদিক ছুটাছুটা শুরু করে কাউকে না কাউকে যেন খুঁজে বেড়ায়। বান্ধবী নুশরাতের পরামর্শে অগত্যা প্রদর্শনীর আয়োজকের সাথে কথা বলে। ভদ্রলোক সরাসরি চিত্রশিল্পী সজীবের সাথে এই ব্যাপারে নাবিলাকে কথা বলার সুযোগ করিয়ে দেয়। সজীব নাবিলার মতো আল্ট্রামর্ডান শহুরে জীবনে বেড়ে ওঠা তরুণী’র গ্রাম্য জীবনের বৃদ্ধা বুড়ির ছবির প্রতি প্রীতি দেখে ক্ষাণিকটা তৃপ্তি বোধ করে। ভক্ত তরুণী’র পিড়াপিড়িতে সজীব আর না বলতে পারল না। এখন নয়, প্রর্দশনী শেষে দুদিন পর ছবিটি নিয়ে যেতে বলল। তরুণী আহ্লাদ ভরা মনে সজীবকে ছবিটির পারিশ্রমীক হিসেবে নগত কিছু অর্থ দিতে হাত বাড়াল। সজীব পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বলে, এই ছবিটির জন্য আমি আপনার কাছ থেকে পারসনালী কোন অর্থ নেব না। তবে আপনি ইচ্ছে করলে স্বাধ্যমত কিছু টাকা দিতে পারেন আয়োজককে। যে টাকাটা আয়োজক প্রদর্শনীর খরচ বাবদ যা ওঠে আসবে তা গ্রমের একটি এতিম খানায় খরচ করা হবে। সজীবের কথা মতো ভক্ত তরুণী তাই করল। এবং এই অবকাশে একটু বায়না ধরে চিত্রশিল্পী সজীবকে জানাল, কোন এক সময় তার কয়েকটা ছবি তুলে দিতে পারলে সে খুব খুশি হবে।’ সজীব হিপ পকেট থেকে ম্যানি ব্রাগটা বের করে একটা ভিজিটিং কার্ড তরুণীর হাতে দিয়ে বলল,পরে একসময় যোগাযোগ করবেন।’
ঘটনাক্রমে তারপর থেকেই যখন-তখন নাবিলাকে ছবি তুলে দেওয়াটা সজীবে’র অবসর কর্মে পরিণত হয়ে পড়ে। নাবিলাকে ছবি তোলে দিতে গিয়ে তরুণী’র অনুরোধে সাঁড়া দিতে গিয়ে বেচারা সজীবকে কখনো যেতে হয়ে লেকের পাড়ে,কখনো বা প্রকৃতির কাছাকাছি কোন লোকারণ্য নগরদ্যানে। এই ছবি তোলার সূত্র ধরেই দুজনের কাছাকাছি আসা-যাওয়া চলে। তারপর মনের অজান্তেই একে অপররের কাছের মানুষও বনে যাওয়া। প্রেম-ভালবাসায় টানে দুজন দুজনার জীবনেও যেন জড়িয়ে যাওয়া।
ইতিমধ্যে সজীবের তোলা কিছু ছবিতে দেশের চলমান অনিয়মের দৃশ্যেগুলো রীতিমত গণমাধ্যমে আলোচিত ও সমালোচিত দুটোই হতে থাকে। দিনে দিনে সজীবের পরিচিতিটাও বাড়ে। সাথে সাথে নাবিলাও যেন সজীবের মতো মানুষটিকে মনের মানুষ ভাবতেই গর্ববোধ করে। যা সজীব বেচারাও নাবিলার ভাবভঙ্গিমা থেকে কিছুটা অনুভব করতে পারল। মনে মনে সজীব ভাবে, এই জীবনে অন্তত এমন একজনকে খুঁজে পাওয়া গেল যে তার পেশাগত জীবনে অনুকূল পরিবেশ যোগাতে সহায়ক হবে।’নাবিলার প্রেমের ছোঁয়ায় আজকাল যেন সত্যি সত্যিই সজীব পেশাগত কাছে সার্থকতা খুঁজে পায়। ফলশ্রুতিতে সজীব দিনে দিনে আরও বেশি প্রফেশনাল হয়ে ওঠে। ব্যস্থতার পরিমাণ বেড়ে যায়।
কিন্তু মানুষ কেন যেন কোন ব্যাপারেই ধারাবাহিক ভাবে আগ্রহ ধরে রাখতে পারে না। যেমটি নাবিলার বেলায়ও ব্যকিক্রম ঘটেনি। দু’জনার প্রেম যখন পূর্ণতা পেয়ে প্রায় বিয়ের কাছাকাছি। হঠাৎ ঠিক সেই সময়টায় একদিন নাবিলা সজীবকে একটি নগরদ্যানে ডেকে এনে সজীবের অপ্রত্যশিত যে কখাগুলো শোনায়, ‘নাবিলার বাবা এক ব্যাংকার ছেলের সাথে তার বিয়ে দিতে ওঠেপড়ে লেগেছেন। বাধ্য হয়ে সে যখন সজীবের কথা তার পিতাকে জানায় তখন বাবা চেীধুরী সাহেব নাকি বলেছেন ,‘সাংবাদিক ছেলের সাথে একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিতে সে রাজি নয়। সমাজে সাংবাদিকতা পেশার মর্যাদা থাকলেও এই পেশায় জড়িতদের জীবনের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। তাছাড়া হাতে গোনা দুএক জন ছাড়া অন্যদের অভাব অনটনে জীবন কাটে।’ বাবার কথার পরিপেক্ষিতে নাবিলা তার বাবাকে কথা দিয়েছে সজীবকে তার সাংবাদিকতা পেশা থেকে অন্য পেশায় ফেরাবেই।’
কথা শেষে সজীবকে রিকোয়েস্ট করে নাবিলা বলে, সজীব আমার জানা মতে তোমার তো প্রফেশনার এম বি এ ড্রিগী আছে। তুমি এই পেশা ছেড়ে কোন ব্যাংক কিবা মাল্টি লেভেল কোম্পানিতে জব নাও। প্রয়োজনে আব্বু তোমাকে ভাল জব পাওয়ার ক্ষেত্রে রেফারেন্স করবে। তাছাড়া আব্বুকে দেওয়া কথা মতো তোমার পেশা চেঞ্জ করার পরেই আমাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ভাবা হবে। নাবিলা সজীবের চোখের দিকে মায়াবী নয়নে তাকিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চায়, ‘সজীব তুমি নিশ্চয়ই আমাকে ভুল বুঝবে না?’
নাবিলা’র কথাগুলো সজীবের মগজে বজ্রপাত ঘাটালো। সজীব জানালো , ফটো-সাংবাদিতকা যতখানি-না তার পেশা ,তার চেয়ে বড় কিছু হলো এটা তার নেশা। সে এই নেশাগ্রস্থ পেশা থেকে দূরে থাকার কথা ভাবতেই তার মরণ হবে! এটা কি করে সম্ভব!
সেদিন সম্ভব আর অসম্ভবের প্রশ্নে দু’জনার মধ্যে বাকবিতর্ক ঘটে। কথা প্রসঙ্গে নাবিলা অভিমান নিয়ে বলে, সে আর দেশে থাকবে না। সামনের মাসে বি.বি. এ. শেষ হতেই অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে। তার বড় ভাইয়া আর ভাবির কাছে। ওখানেই এম.বি. এ-টা শেষ করে, সেখানেই সেটেল হয়ে যাবে। আর কখনও দেশে ফেরা হবে না। লাশটা ও পর্যন্ত ফিরে আসবে না..,কথা শেষে নাবিলা’র চোখর পাতা জলে ভেজে যায়। অভিমান নিয়ে সজীবের সামনে থেকে হনহনিয়ে চলে যায়। নাবিলা প্রস্থান করার পর, সজীব বিষণ্ন মেজাজে দুহাতে নিজের ঘাড় চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলে, ‘ওফ! সাংবাদিক ছেলে পচন্দ নয়! তবে কেন বা আমাকে ভালবাসতে এলে?’ ভালবাসায় কাতর মনে নাবিলার প্রতি সজীবে’র রাগ পড়ে যায়। বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেলেও নাবিলা সজীককে কল করে না। সজীবও পেশাগত কাজে নিজেকে ব্যস্থ রাখতে যেন ওঠেপড়ে লেগেছে। তার উপর সামনের মাসেই একটা গ্যালরীতে তার ছবির প্রর্দশনীর ব্যাপারে কথা চলছে এক আয়োজকের সাথে। সে নিয়েও এখন সজীবের অতি ব্যস্থতা। এই ব্যস্থতার মধ্যেও নাবিলা’র কথা মনে পড়তেই সজীবের দম যেন বন্ধ হয়ে আসে। অতৃপ্তির বেদনায় বুঁকের খাঁচায় অসহ্য ঝাকুনি খায়। চুপচাপ ভাবে, যে চলে যেতে চায় জোর করে কেন তাকে ফিরাতে যাব! শিল্পী জীবন মানেই তো- পুরোটাই দুঃখ আর বেদনার হাতছানি।’
গতকাল পত্রিকার সম্পাদক স্যার চিত্রগ্রাহকের নামসহ সজীবের তোলা ছাবিটা প্রথম পাতায় ছেপেছিলেন। তা পর থেকেই গণমাধ্যমে এক ভদ্র নেতার অপকর্মগুলো প্রকাশ পায়। রাতে কারা যেন সজীবের মোবাইলে কল করে তাকে প্রলোভন এবং জীবনের হুমকী দুটোয় দেয়। সজীব পরিচয় জানতে চেয়েছিল। কিন্তু ও পার থেকে আর জবাব আসে না। পরের দিন এক কলীগের পরামর্শ মতো সে পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে থানায় অজ্ঞাত নামে একটা জিডি করে। দুদিন পর আইন শৃঙ্খলা বাহিণীর পরিচয় দিয়ে সাধারণ বেশধারী কয়েক জন জোরাজোরি করে সজীবকে দিনে দুপুরে পত্রিকা অফিসের সামনে থেকে একটি সাদা রঙ্গের মাক্রতে করে তুলে নিয়ে যায়।
পরের দিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ফটো-সাংবাদিক সজীবকে অপহরণ হওয়ার খবরটি হাইলাইট করে ছাপা হয়। সকালে ঘুম থেকে ওঠে খবরের কাগজ হাতে পেতেই নাবিলা অস্থিয় হয়ে পড়ে। অগত্যা পত্রিকা অফিসে ছুটে আসে। সজীবের কলীগরা নাবিলাকে আগে থেকেই চেনে-জানে। নাবিলা ঘটনার সত্যতা জানতে কলীগদের প্রশ্ন করে উত্তর পায় না। সজীবের সেটে কল করলেও কল হয় না।
এক এক করে সপ্তাহ খানিক কেটে যায়। তবুও সজীবের ফিরে আসা হয় না। গণমাধ্যমকর্মীরা সভা-সমাবেশ করে বিক্ষোভ প্রতিবাদ জানায়। সজীবকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হয়। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় মৌন প্রতিবাদ জানায়। তাতেও সজীবের খোঁজ মিলল না!
দুদিন পর বুড়িগঙ্গার তীরে মস্তকবিহীন লাশ বেসে ওঠে। খবরের পাতায় চোখ রেখে নাবিলা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞানপ্রায় অস্থির হয়ে পড়ে। যদিও লাশ সনাত্ব করে নিশ্চিত হয়-না এটা সজীবের লাশ নয়! তারপর থেকেই পাঁচ দিন সাত দিন পর পরই দেশের বিভিন্ন জাগায় অজ্ঞাত পরিচয়ে লাশের খবর পত্রিকার পাতায় ছাপা হলেই নাবিলা যেন বেদনাকাতর হয়ে পড়ে। পরে নিশ্চত হয় , না এটাও সজীবের লাশ নয়। নরপশু ঘাতকরা সজীবের লাশ যেন তার স্বজনদেরও দেখতে দিবে না। তারা সজীবকে এতো দূরে নিয়ে গেছে যেখান থেকে মৃত সজীবের লাশের গন্ধটাও বোধ হয় প্রকৃতিকে আর বহন করতে হবে না। আর এদিকে সজীবের অপেক্ষায় নাবিলা প্রতিরাতেই বেদনার বাসর সাজায়। প্রতিদিনই সজীবের সেই শেষ দুটি ডিজিট ..৮৩ নাম্বারে কল করে। কল হয় না। নাবিলা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ডাক্তার অরুণ নাবিলাকে মিছে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা চালায়। ইতিমধ্যে নাবিলার প্রতি ডাক্তার অরুণের ভিন্ন আবেগ জন্মায়। আজকাল সে আবেগটাই যেন ডাক্তার নাবিলাকে বুঝাতে অস্থির হয়ে পড়েছেন। ‘যেটা হয়েছে সেটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। তাই বলে জীবন থেমে থাকে না.. এভাবে আর কতো দিন?’ অস্থিরচিত্তে ডাক্তার অরুণ নাবিলার কাছে জানতে চায়। নাবিলা বরাবরের মতোই বেদনাকাতর স্বরে সেই একই প্রশ্ন করে জানতে চায়, সজীব কখন ফিরে আসবে ডাক্তার? তারপর নাবিলার চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে তার দু’গাল ভিজে যায়। বুকের মাঝে শোকের আঘাতে নাবিলার সব চাওয়া-পাওয়া গুলো ভেঙ্গে চুরমাড় হয়ে যায়।
এ যেন এক অপূর্ণ প্রেম-কাহিনি। সজীবের সাথে নাবিলা প্রথাগত নিয়মে প্রণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়নি তা বটে, কিন্তু মনোজগতে সজীবকেই তো সে সঙ্গী করে নিয়েছিল। যাকে ভেবে জোসনা রাতে নিজেকে সজীরের তরে বিলিয়ে দিতে মনে বড় স্বাধ জেগেছিল। যার প্রেমে আসত্ব হয়ে কল্পনা জগতে নিজেকে লুপ্ত করে অঢেল আবেগে-আপ্লুত হয়েছিল। তাকে তো একদিনের জন্যও একান্ত বাঁধনে জড়ানোর মতো সুযোগ হয়ে ওঠেনি নাবিলার। এ যেন এক অতৃপ্ত বেদনা! এ যেন সদ্য বিধবা নারীর বেদনা অধিক বেদনাময়। যে পরিমাণ বেদনা দাম্পত্ত জীবনের শুরুতে পতির অকাল প্রয়াত বিধবা নারীর বেদনাকেও ছাপিয়ে যেতে চায়-সে পরিমাণ বেদনায় আজ-কুমারী মেয়েটি যেন বিধবা নারী!
-০-
Comments 0