গানের কইন্যা
আরিফ মজুমদার
সঙ্গীত জগতে কে কি উদ্দেশ্যে ইন করছে-সেটা নিয়ে আমার মাথা না ঘামালেও চলবে। এইসব নিয়ে ভাবার মতো ইমতিয়াজ বুলবুল কিবা শেখ সাদীর মতো অনেক গুণীজনরা এখনও সশরিরীরে জীবিত আছেন। ইদানিং যেটা নিয়ে অতৃপ্তবোধের গ্লানীতে রাতবিরাতে মনটা ঘোঁমরিয়ে ওঠছে সেটা হলো-আমি যে মোটিভ নিয়ে গায়িকা হতে চেয়েছিলাম তা-কী আজও হতে পেরেছি? কিবা আমি কি সে দিকেই নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে এগুচ্ছি? না! তা-তো করছি না। আমি শুধু স্টার হতে পেরেছি। সুপার স্টার। জানি আমার এখন আমাশচুম্বী জনপ্রিয়তা! এখন আমি ছাঁইফাস যা-গাই, তা-ই হয়ে যায় সুপার হিট। আমার কনসার্ট মানেই আমজনতার ঢল নামে। যতটুকু না গান শুনতে আগ্রহী শ্রোতাদর্শক তার চেয়ে অধিক উৎসুক জনতা আমার উঠতি যৈবনা উন্মুক্তপ্রায় দেহখানা দেখতে। স্টেজ শো’তে আমার সানি লেওন টাইপের গেট-আপ আর যৈন উত্তেজক অঙ্গভঙ্গিতে আমজনতা থেকে শুরু করে সহ সিঙ্গার, মিউজিসিয়ান, আল্ট্রামর্ডান মেয়েরা পর্যন্ত হারিয়ে যায় মানিক বন্দোপদ্যায়ে’র প্রগৈাতিহাসিক গল্পের উন্মাদনায়। দেশের সীমানা ফেরিয়ে প্রবাসীদের কাছেও আমি সমান আদরনীয়। এম্নকি ফ্রি-সেক্সের কান্টি ইউরোপ প্রবাসী বাঙ্গালীরা পর্যন্ত আমাকে নিয়ে অতি উৎসুক হয়ে পড়েছেন! গতমাসে নিউইয়ার্কে’র মতো ব্যস্থতম শহরে যে তিনটি শো’তে আমি পার্টিসিপেট করেছিলাম সব গুলোতেই প্রবাসী আমুদে বাঙ্গালীদের পাশাপাশি পাকিস্থান, ভারত, মিসরসহ নানা দেশের প্রবাসীদের উপস্থিতি ছিল ঈর্ষান্বিত। আমি দেখতে যেমনটি হই-গায়ে পোশাকের পরিমাণ কম বা সাইজ জিরো বলেই আমি এতো হট-হিট-সিক্সি। ঢাকার অভিজাত ফাইভ স্টার হোটেলে’র কনসার্ট মানে আমাকে পারর্ফম করতে-ই হবে। যদিও শো’তে গাওয়ার চেয়ে মিওজিকের তালে তালে আমাকে নাচের কৌশলে অঙ্গভঙ্গিটাই বেশি করতে হয়। আমি খুব ভাল নাচ জানি তাও নয়। কিভাবে আর্ট করে নাচতে হয় তা নিয়েও আমি কখনো উদ্বিগ্ন নই। স্টেজে আমি শুধু নারী দেহের লোভনীয় অঙ্গসমূহ হাইলাইট করি- তাতেই দর্শক মোহমুগ্ধ। এতো দর্শকপ্রিয়তা নিয়েও যখন ভাবি, আমি কী আজও পারতপক্ষে কোন গায়িকা? হুম। আমি সিঙ্গার।পপুরার সিঙ্গার। আমার সাথে এই সময়কার দু’ বাংলার যে কোন মানের মেল-সিঙ্গার ডুয়েট করতে বিনা-বাক্যে এ্যাগ্রী। তবুও হতাশা আমাকে গ্রাস করে। কারণ আমি জানি কোন শ্রেণীর গায়িকা আমি! আমি শুধু জোয়ারের স্রোতে ভেসে যাওয়া শ্যওলা। ভাটা আসবেই। আর তখন আমিও হারিয়ে যাবে। তখন তো কেউ আর আমার নামটিও স্নরণ করার মতো এইটুকু আগ্রহ রাখবে না। যেমটি আমার চেয়েও অনেক হিট-হট স্টারদের বেলায়ও ঠিক ঠিক প্রমাণিত হয়েছে..।’ রাজধানীর একটি ফাইভ স্টার হোটেলে কতিপয় ভিআইপিদের উপলক্ষ্যে আয়োজিত শো শেষে গভীর রাতে বাসায় ফিরে নিজের আরামদায়ক বিছানায় বালিশে মুখ গুঁজে কথাগুলো বলতে বলতে লিলিয়া অতৃপ্তাবোধের গ্লানীতে হাঁপাচ্ছে। আর এদিকে সাইলেন্ট করা মোবাইল সেট-টায় লাগাতার কলে’র পর কল আসছে। লিলিয়া জানে যারা কল করছে, তাকে নিয়ে তাঁদের অধীর আগ্রহ। আজকের শো’টা ছিল সমাজের এলাইট পারর্সনদের জন্য। যেখানে ছিলেন কোটিপতি ব্যবসায়ী ও উচ্ছপদস্থ কর্মকর্তসহ গণা কয়েক সাংসদ বা মৎস ব্যবসায়ী। যারা শুধু মাছ চাষ করেই নাকি কয়েক ’শ কোটি টাকার বাড়ি-গাড়ি আর নগদ ব্যাংক মানির মালিক হতে পেরেছেন। এখন তাঁদের কেউ হয়তো নিজের আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে বলে ফেলবে,‘ আজ রাতের শো’তে আপনার পারফরমেন্সটা খুব্বই ফাটাফাটি হয়েছে।’ কেউ হয়তো আমাকে মানে আমার দেহটাকে উপভোগ করতে অল-লেডি অস্থির হয়ে পড়েছেন-তাতে পাঁচ-দশ লাখ যাই লাগুক, আমি রাজি হলেই সই। এঁদের মধ্যে হাই-ফ্রোপাইলধারী কেউ হয়তো একটু দুর্বলমনা এবং নিজের পারসোনালিটির ব্যাপারে খুবই সেনসেটিভ। যদিও উদ্দেশ্য একই তবুও একটু ভিন্ন সুরে বলবে, ‘ইপ য়ু এ্যাগ্রি,আই ওয়েন্ট-টু-মেরি-য়ু … সুইট এন্ড ফায়ার গার্ল।’ ফায়ার গার্ল মানে অগুনের কইন্যা। আর এ-অগুন মানে আমার মনা কাড়া রূপ লাবণ্যেভরা ঢেউ তোলা যৈবন। আমি যখন মাঝে মধ্যে ভাবি, আমার মন যাকে নিজের করে পেতে উৎসুক সে কী আমার মতো খোলামেলা দেহে দু’বাংলার হিট তারকাদের গায়ে পড়ে যখন তখন সেলফি তুলে সামাজিক সাইটে ছবি পোষ্ট করে নিজের খ্যাতিটা বাড়াতে মরিয়া হয়ে পড়া মেয়েদের প্রতি লোভাতুর? সে কি লাইক করবে আমার মতো কাঙ্ক্ষিত বালিকাটিকে যে কিনা রাত বিরাতে রাজধানীর অলিগলিতে কোন না কোন স্টুডিও তে এ্যালকোহলের গ্লাস হাতে মিজিসিয়ান বা মেল সিঙ্গারদের সাথে বন্ধত্ব বা সামাজিকতার স্বার্থে আড্ডায় মাতে! আজব! তবে আমি কেন তাকে ভালবাসতে যাবো!যে কিনা এইসব কাজগুলো মোটেই পচন্দ করবে না! আমাকে এমন এক জনকে জীবন সাথী হিসেবে বেচে নিতে হবে যে আমার মতো হিট-হট আর অবাধ খোলামেলা জীবনে অভ্যস্থ আর যার আছে অঢেল অর্থকরি, গাড়ি-বাড়ি। আজকাল মিডিয়া বা সঙ্গীত জগতে যারা আমার আশেপাশে ভীঁড়ে ,তাদের খ্যাতিটা থাকলেও অর্থকরি তেমন একটা নেই। পাইরেসির এদেশে আগের মতো এখন আর রয়েলেটি পান না শিল্পী বা মিজিসিয়ানরা। অভাব অনটনেই এখন বেশির ভাগ সেলেব্রিটির লাইফ কাটে। আজকাল প্রায় ভাবছি, পলিটিসিয়ান বা ব্যবসায়ী পাত্রকেই বেঁচে নিবো লাইফ পার্টনার হিসেবে। যার থাকবে প্রচুর অর্থ। বুকের ভেতর ঝমে থাকা কষ্ট আজ আমাকে প্রকাশ করতেই হবে, আমি যতোবার চেয়েছি বাসার বাহিরে বেরুবার সময় মাথায় হিজাব নিবো,কামিজ-স্যালোয়ার পরবো কিন্তু কখনও তা আর পরা হয়ে ওঠেনি। বাসায় আমার দেহের যতটুকু কাপড় দ্বারা আবৃত থাকে তার চেয়েও অর্ধেকটুকু পষর্ন্তু বাহিরে বেরুলে বিশেষ করে কোন শো-টো-তে গেলে পোশাক দ্বারা আর ঢাকা থাকে না। এখন আমি স্টেজ শো গুলোতে এক জীবনে বিধাতার উপহার নিজের ফর্সা দেহটাকে লোক সমাজে লোভনীয় করে রাখাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করি। নিতান্তই নিষ্পয়োজনে অতি ব্যক্তিগত ইসু নিয়ে অনুশোচনা করছি, আমি কেন তাকে ভালবাসতে যাবো! সে আমার মতো লাইফে মোটেই অভ্যস্থ নয়! হুম,আমি তাকেই কাছে টেনে নিবো, যে আমার মতো মেয়ে তারকাদের দেহের লোভে পড়ে সস্তা কথায় সুরহীন একটার পর একটা ডুয়েট সং করতে মরিয়া হয়ে পড়ছে আর মিউজিক ভিডিওর আড়ালে ডিজিটাল ক্যামেরার কারসাজিতে ইউটিউব বা টিভি স্কেনে নারী দেহের প্রদর্শনটাই মূখ্য করে তুলছে। হায়! গড। ছোট বেলা যখন সঙ্গীত সাধন করতে গিয়ে অনায়াশে গাইতাম..‘আমারও পরানে যাহা চায়। তুমি তাই গো- তুমি তাই..।’ তখন বাবা আমার মাথায় হাত রেখে বলত,‘মা মণি আমার অনেক বড় গায়িকা হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।’ বলতে গিয়ে বাবার চোখের পাতা মায়ার জলে ভরে ওঠত। বাবা ছিলেন রবীন্দ সঙ্গীতের ভক্ত। বাবার কথা মনে পড়লে দুচোখের পাতা জলে ভরে যায়। আজ বাবা বেঁচে নেই। অপরিণত বয়সে কার অ্যাকসিডেন্টে আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। আর আম্মু তো বাবারও আগে আমাকে ফাঁকি দিয়ে র্ভাসিটি লাইফের প্রেমিকের হাত ধরে দেশ ছাড়লেন। আমার খোঁজ কখনো নেন নি। শুনেছি কানাডা থাকেন। কিন্তু আমি আজও খোঁজ পাইনি। আজ সৎ মায়ের সংসারে বাবা বেঁচে থাকলে বোধ হয় আমার কষ্টবোধটা বাড়তো দ্বিগুণ। কেননা বাবার সামনে দাঁড়ানো’র মতো গায়িকা তো আমি আজও হতে পারি নি। আমার সং হিট হয়। তবে সেটা মানুষের প্রাণের গান নয়। সে গান মানে যৈন উত্তেজক কিছু নোংরা কথার চিৎকার চেঁচামেছি । দীর্ঘদীন যাবত হালের কয়েকজন গীতিকার ও সুরকারদের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে একটি ভাল মানের সিডি করব করব ভেবে। কিন্তু কথা বা সুর কী ধাঁচের হবে তা নিয়ে ভাবনায় অস্থির তাঁরা। আমি নিজেও এখন পর্যন্ত কোন ডিসিশনে আসতে পারিনি। গানগুলো কী রকম হওয়া উচিত? শ্রোতারা কী রকম গান আমার কাছে প্রত্যাশা করবে? আমার নিজের প্রত্যাশা-টা বা কী? বাবার কথা ভাবব নাকি সময়ের স্রোতে নিজেকে ভাসাবো? এই জাতীয় হাঁজারও প্রশ্ন। বাবার কথা প্রাধাণ্য দিতে হলে যে টাকা ব্যয় করে সিডি বাজারে ছাড়ব তা কখন ওঠে আসবে না। টাকা রির্টান পাবার পথ খোলা আছে একটাই-সেটা হলো স্টেজ পারফরমেন্স আর নাইট-শো। আর স্টেজ পারফরমেন্স মানেই আমাকে অর্ধনগ্ন পোশাকে হাঁজার দর্শক মাতাতে হবে। সাথে গানটাও চাই অগ্নিঝরা যৈন উত্তেজক। সুরেলা গান দিয়ে স্টেজ কাঁপানো তো দূরের কথা শ্রোতাদর্শকের মনোয়োগ আকর্ষণ করাও দায়! রবীন্দ সরোবরে গত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মোটামোটি বিখ্যাত এক ভদ্র মহিলা রবীন্দ সঙ্গীত গাইতেছিলেন । পাশে গীটার প্লে করছিলেন মনোয়ার হোসের টুটুল দা। দেখা গেলো দু-টা গান গাইতে না গাইতেই শ্রোতাদর্শকের বিরক্তিবোধ প্রকাশ পেল। কিন্তু আমি যখন স্টেজে পারর্ফরম করি তখন ঘন্টা ফেরিয়ে গেলেও দেখি শ্রেতাদর্শক আমার দিকে হাঁ মেরে-ই চেয়ে থাকে। আর যখন থেকে আমার হেয়ার স্টাইল ও কালার বদল করে ‘ওয়াক ওয়াকা’ খ্যাত পশ্চিমা কইন্যা শাকিরা টাইপের হোয়াইট করে ফেললাম তখন থেকে দর্শকমহলে জোর কানাগুশা চলছে আমার জন্ম নিয়েই- আমি কি আদৈা বাঙ্গালী মেয়ে নাকি পশ্চিমা জাতের কইন্যা । আর যাই হোক তারপর থেকে আমার জনপ্রিয়তা বাড়ল দ্বিগুণ। বুঝতে আর অবশিষ্ট নেই দর্শকশ্রোতারা আমকে দেখেই শো-টা উপভোগ করে- গানটা শুনে নয়। আমি হালের সিঙ্গার মিনা-তিনার চেয়েও বেস্ট পারফর্ম করতে পারি বৈকি! মাঝে মধ্যে নিজেকে সাদা চুলের কিউট বাঙ্গালী গায়িকা অমুক কইন্যা’র চেয়েও বেশ কয়েকগুণ হিট-হট মনে হয়। হালের ফিল্মে অ্যাকটিং করার জন্য কম করে হলেও একুশটা ওপার পেয়েছি। কিন্তু এখনও সাড়া দিই নি। কারণ চলচিত্রে’র নায়িকা বেচারি’রা কাতো কষ্টে পরিচালক-প্রজোযোগদের নানা ভোগান্তি সহ্য করে অনেকটা বাধ্য হয়েই চুক্তিবদ্ধ ফিল্মের কাজটা শেষ করে যে অর্থ পায়; আমি জুতসই একটা নাইট-শো করেই সমান মানি আর্ন করতে জানি। তবুও অতৃপ্তবোধের তৃক্ততায় আমার ভেতরটা জ্বলে যায়- যখন সঙ্গীত সমঝদার পিতৃসম কেউ স্বস্হেনে আমাকে শুধায়, ‘কী হে গানের কইন্যা তোমার সঙ্গীত সাধন কেমন চলছে?’ জবাবে যদিও বলি, জ্বী আঙ্গেল খুব ভাল যাচ্ছে। কিন্তু ভেতরটা ঠিকই পুড়ে যায়, কইন্যার সঙ্গীত সাধন যে মোটেই ভাল যাচ্ছে না। সর্বদাই একটা আতংকের ভেতর মনটা ঘুরপাক খায়, কাল থেকেই বুঝি শ্রেতাদর্শকরা আমাকে আর চাইবে না। দিনের ব্যস্ততা শেষে রাতের আঁধার যতো বাড়ে কষ্টের হাহাকারে বুকের ভেতরটা ততো বেশি বিষিয়ে ওঠে। আয়নার সামনে এসে দাঁড়াই-আমার রূপ লাবণ্য গতকাল যেনমটি ছিল আজ যেন আর তেমটি নেই। ক্ষয়ে যাচ্ছি আমি! আমার দু’চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। আমি অপরাধবোধ নিয়ে কান্না চেপে বলি,‘বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিও, তোমার মা-মণি স্টার হতে পেরেছে- আজও শিল্পী হতে পারেনি! ’
-০-
Source
Comments 1