http://www.poriborton.com/arts-and-literature/949/-Facebook
ওগো প্রেমিক, তোমার প্রেমের অদৃশ্যবাণে আমি অবিরত খুন হয়ে যাই! আমার স্বপ্ন-আমার চাওয়া পাওয়া উৎস আজ শুধুই তুমি। এই জাতীয় বা এর চেয়ে অধিক আবেগ জড়িত প্রেমময় কথামালা তাদের মাঝে কতোটুকু বিনিময় হয়েছে সেটা বলা দায়। যতোটুকু জানি, সামিয়া আর শামিরের সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটেছিল ফেইসবুকের কল্যাণে। রাত-বিরাতে দুজনার টুকটাক চ্যাট হতো। কখনো-কখনো চ্যাটিং করতে গিয়ে দুজন দুজনার প্রতি খুবই রোমান্টিক হয়ে উঠত।
সামিয়া মেয়েটার রূপগুণ যতটুকু তাতে চিত্রজগতে রাতারাতি সুপারস্টার বনে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু আছে বলে শামিরের কাছে মনে হয় না। যাই-হোক, শামিরের এক তরুণ চিত্রপরিচালক বন্ধু একদিন শামিরকে ফোন করে জানাল, তার আগামী ফিল্মের জন্য নবাগতা খুঁজছে। জানাশুনা কেউ থাকেলে তাকে জানাতে। রাতে ফেইসবুক চ্যাটে সামিয়াকে সে ব্যাপারটা জানাল। জবাবে সামিয়া যেন একটু বিরক্তবোধই প্রকাশ করল, ‘ভাইয়া, খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই! আপনি কি আমাকে কখনো দেখেছেন?’ অপ্রত্যাশিত ম্যাসেজটা পেয়ে শামির রীতিমত থতমত খেয়ে গেল। উত্তর দিল: ‘নো, লেট’স উই মিট নেক্সট ফ্রাইডে। আমি সপ্তাহের ওদিন বিকেলের দিকে যমুনা ফিউচার পার্কে আসি। ফ্রি থাকেন চলে আসেন।’ ‘ট্রাই করবো।’ সে উত্তর দিল।
দুদিন পর ফ্রাইডে বিকেলে শামির যমুনা ফিউচার পার্কে যেতে পারে নি। এদিকে সামিয়া সন্ধ্যে পর্যন্ত অপেক্ষা করে বিরক্তবোধ নিয়ে বাসায় ফিরলো। রাতে শামিরকে চ্যাটে পেয়ে টেক্সট করল, ‘বিকেলে এসেছিলেন?’
‘না। আপনি এসেছিলেন?’
‘আগে বলুন, কেন আসতে পারেননি?’
‘ঢাকার বাইরে ছিলাম।’
‘নিউইয়র্ক নাকি লন্ডন?’ সামিয়ার মনে অভিযোগ।
‘ গ্রামে গিয়েছিলাম। দাদু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন গতপরশু হঠাৎ শুনতে পেলাম।’
‘হুম। ক্যান আই গেট ইউর সেল নাম্বার, প্লিজ!’
শামির সেল নাম্বারটা ম্যাসেজ করে দিল। সাথে সাথে শামিরের মোবাইল সেটটা বেজে উঠল। শামির সেটটা কানের কাছে ধরল। ও পাশ থেকে ভেসে এলো
‘হ্যালো, কে বলছেন?’
‘আমি শামির।’
লেকের পাশটায় গাছের ছায়াপথ ধরে আনমনে হেঁটে যাচ্ছে শামির। ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার এই স্থানটুকু নগরবাসীকে ক্ষণিকের জন্য হলেও যেন গ্রামের শান্ত শীতল নির্মল পরিবেশটা মনে করিয়ে দিতে চায়। বিকেলের শেষ বেলা।দিনের এই ক্ষণটায় কর্মব্যস্ত মানুষ নিজের দেহের ভারটুকুতেই যেন অসহ্য অনুভব করে।সারাদিনের ব্যস্ততার ধকল সামলাতে গিয়ে শরীরটায় বড্ড ক্লান্তবোধ হচ্ছে শামিরের।
লেকের যে পাশটায় শামির বসে আছে তার ঠিক উল্টো দিকটাই ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়ক, মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর। বাড়িটির দিকে তাকিয়ে আনমনে কী যেন ভাবছে শামির। বইয়ের পাতায় পড়া মুজিবের বিরত্বগাথা ইতিহাস শামিরের মনের আঙ্গিনায় হয়তো বা জেগে উঠতে চাচ্ছে। যদিও তার আশেপাশের লোকজনের কথাবার্তার ফিসফিস আওয়াজ ক্রমাগত হচ্ছে। তরুণ-তরুণী যুগল দেহে দেহে হেলে বসে কী সব অনবরত বকে যাচ্ছে যার কারণে তার বিরক্তবোধ হচ্ছে বৈকি!
শামির যেন পরম মমতায় তাকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটার দিকে। হঠাৎ ‘বাবা’ ডাকটা কানে পৌঁছতেই পেছন ফিরে তাকায় সে। ‘সাহায্য দিবেন বাবা’, বলে লোকটা ক্ষীণ আকুতি জানায়। বৃদ্ধের বয়স আশির কম না। দেখে মনে হচ্ছে, আঘাত পাওয়া ডান পাটায় বোধ হয় হাঁটার মতো শক্তি বা বল বলে কিছু নেই। তার ওপর বয়সের ভার। তাই শক্ত করে লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে হচ্ছে। মালার মতো করে গলায় ঝুলানো যে সাদা কাগজের সাইনবোর্ডটি আছে, তাতে মোটা অক্ষরে লেখা : ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা’। শামির ক্ষাণিকটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে লোকটায় পানে।
শামিরের এই বিস্ময়-হতবাক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিরক্তিবোধ ভেবে বৃদ্ধ নিরাশ মনে পাশ কেটে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। শামির কিছু টাকা হাতে নিয়ে লোকটাকে ডাকে। প্রথমে ভেবেছিল কিছু জানতে চাইবে পরে আবার কি যেন ভেবে চুপচাপ টাকাটা লোকটার হাতে তুলে দেয়। বৃদ্ধ টাকাটা হাতে নিয়ে সামনের এগিয়ে যায়। আর তখনই যেন শামিরের সন্দেহ হয় : লোকটা কী সত্যি-সত্যি মুক্তিযোদ্ধা! শামির ভাবে। লেকের ঐ পাশটার দিকে তাকায় সে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িটাকে কেমন যেন নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে! স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধারা ভিক্ষা করবে! দু’মুঠো ভাতের জন্য তারা পথে পথে আকুতি জানাবে! তবে এই যে চারপাশের বিশাল বিশাল অট্টলিকাগুলো কাদের প্রয়োজনে শোভা পাচ্ছে? কারা বিলাসিতায় আনন্দ-ফুর্তিতে এইসব আকাশচুম্বী বাড়িতে দিনযাপন করেছে?
সন্ধ্যা নামতেই তার কানে ভেসে আসে সামিয়ার সে প্রেমময় কণ্ঠস্বর, ‘ওঠো শামির। বাসায় ফিরতে হবে।’ মাত্র কয়েকটা দিন আগেই সামিয়াকে সাথে করে জাতির পিতার স্মৃতিজাদুঘর ৩২নং বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখেছিল দু’জন। আহ! ঘাতকরা কী নির্মমভাবেই না হত্যা করেছিল জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। সামিয়া সেদিন বেদনাকাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বাড়িটার ওইখানে, যেখানে ঘাতকদের বুলেটের চিহ্ন জীবন্ত বলে মনে হচ্ছে সেখানে। মানুষ কতটা হিংস্র হতে পারে! শামিরের মন আবেগপূর্ণ ভাবনায় বিভোর হয়ে পড়ে।
২
অভিজাত এলাকার ফাস্টফুডের শপে মুখোমুখি বসে আছে শামির-সামিয়া।
‘কেমন আছেন?’ নীরবতা ভেঙে সামিয়া চোখ তুলে জানতে চায়।
‘ভাল।’
তাদের খাবার এলো।
‘প্লিজ, নিন।’ একটি প্লেট সামিয়ার দিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে দুজনার চোখাচোখি হওয়াতেই একটু লাজুক হাসি চেপে নিলো সামিয়া। ‘আপনাকে ভীষণ সুইট লাগছে’। শামির ধরা গলায় বলল।
‘তাই!’ সামিয়া এক টুকরো মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, পত্রিকা আর ম্যাগাজিনের পাতায় আপনার লেখা অনেক পড়েছি। আজ আপনাকে সামনে পেয়ে মন্দ লাগছে না।’
‘ধন্যবাদ। আপনাকে আসতে বলেছি যে কারণে সেটি হলো, আমার এক নবিশ চিত্র পরিচালক বন্ধু সেদিন ফোন করে তার আগামী ছবির স্ক্রিপ্টটা আমাকে লিখতে বলল। আমি প্রায় শেষও করে ফেলেছি। এখন সে তার ফিল্মে নায়িকা চাচ্ছে নবাগত। ভাবছি, আমার এই স্ক্রিপ্টটার হিরোইন হিসেবে আপনাকে বেশ মানাবে। আমার কল্পনাতে নায়িকার ভূমিকায় আপনিই ছিলেন। এখন আপনি কী জবাব দিবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।’ একথা শুনে সামিয়া রোমান্টিকতার অবয়বে মৃদু হাসি চেপে বলল, হুম! নায়িকা হতে পারলে হয়তো ভাল কিছু করা যেত। যদিও চিত্রজগতের প্রতি আমার তেমন আগ্রহ নেই। মাস ছ’য়েক হল আমারা ফেসবুক-চ্যাটিং করছি। যে কথাটি বলতে চেয়েও বলা হয়নি, ভাবলাম সরাসরি বলে আপনাকে খানিকটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাক। তাই আজ চলে এলাম। শামির ভাবছে, আমিও তো কখনো বলতে পারিনি আমার কথাটি। সামিয়া বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল আমি কী বলতে চেয়েছি।
আমাকে শুনছেন? শামিরকে অন্যমনস্ক দেখে সামিয়া করে।
কী যেন বলবেন সরাসরি? সামিয়া একবার শামিরের দিকে তাকিয়ে নিলো। তারপর বলল, সামনের মাসে হয়তো আমার এঙ্গগেজমেন্টটা হয়েই যাবে নিউইয়র্ক প্রবাসী আমার কাজিনের সাথে। হয়তো আমিও চলে যেতে পারি নিউইয়র্কে।
সামিয়ার মুখ থেকে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কথাগুলো শুনে শামির নিজেকে জোর করে ঠিক রাখার চেষ্টা করে বলল, হুম, বি গুড নিউজ। তারপর মাথার উপরে লাইটের দিকে তাকিয়ে সামিয়ার দিকে নজর ফিরিয়ে নিয়ে জানতে চাইল, আপনার মতামতটা?
আপনার হিরোইন হবার কথা বলছেন? শামির কথার সরাসরি উত্তরটা না পেয়ে আরেকটু সময় নিয়ে বিশ্লেষণ করে সামিয়াকে বুঝাতে চাইল, ধরুন আপনি ফিল্মে কাজ করতে চাচ্ছেন। কিন্তু দেখা গেল আপনার স্বামী বাধা দিলো? তাই আপনাকে বিয়ের আগে ভেবে নিতে হবে, চিত্রজগতে পা রাখবেন কী রাখবেন না।
সামিয়া একটু সময় নিয়ে বলল, আপাততঃ ফিল্ম নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। কাজ করতে ইচ্ছে হলে আপনাকে নিশ্চয় জানাবো।
‘হুম, গুড। তার মানে আগে বিয়েটা সেরে ফেলতে চাচ্ছেন?’ এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে সামিয়া নতদৃষ্টিতে চুপ মেরে রইল। শামির জিঙ্গাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সামিয়ার দিকে।
মন খারাপ আপনার? নীরবতা ভেঙে চোখ তুলে সামিয়া অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করল।
মন খারাপ কী না ঠিক যেন বুঝতে পারছি না। তবে এখুনি যে উঠতে হবে। সন্ধ্যের পর একটু পান্থপথের দিকে যেতে হবে। আশা করি আপনার অনাগত দিনগুলো ভাল যাবে। সামিয়া কোমলস্বরে হাত বাড়িয়ে অনুনয় করে বলল, আমরা আরেকটু বসি। আপনি কী বিরক্ত বোধ করছেন?
‘বিরক্তবোধ? তা কেন হবে। ভাবছি হয়তো আর কখনো এভাবে দুজনে পাশাপাশি বসার সুযোগ হবে না। এই সন্ধ্যেটা বড়ই স্মৃতিময় হবে অভাগার এই ক্ষুদ্রজীবনে। আর স্মৃতি মানেই তো বেদনায় হাতছানি।
‘বেদনার হাতছানি!’
‘হুম।’
‘কেন?’
‘জানি না। না জানলে বুঝলেন কি করে?’
‘ভেতর থেকে আসল, তাই বললাম। মানুষের মনের ভেতর কত অপ্রয়োজনীয় ভাবনার-ই তো উদয় হয়! এইসব বলতে বলতে সামিয়ার মুখের দিকে শামিরের নজর পড়তেই চমকে গেল। একি! তুমি কাঁদছো? সামিয়া হাতের পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল, ডিসিশনটা আমি এখনো নিই নি। আপনি একটা পাষাণ? সামিয়া কেমন যেন ভিন্নত্বরে কথাগুলো বলল। কী করে ভাবতে পারলেন আমি তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারি! আমি কী এতোই নিষ্ঠুর-পাষাণী!’
‘না। তুমি মোটেই পাষাণী নও। নিষ্ঠুরও নও। তুমি হলে খাঁটি মায়াবিনী। হঠাৎ আপনি থেকে তুমি তুমি বলে বলতে গিয়ে সামিয়া একটু দম নিলো। তারপর শামিরের স্বরে সুর মিলিয়ে জবাব দিল, ‘ডান..চুপ করো।’
‘ওকে.. বাট যাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারছ না, সেই মহা সৌভাগ্যবান মানুষটি কে?
‘জানি না।’
‘জান না!’ শামির আহ্লাদভরা গলায় বলল।
দুজনার চোখে চোখ পড়তেই একটু আবেগী হাসি ফুটে উঠল দুজনার মুখজুড়ে।
শামির সামিয়ার হাতটি চেপে ধরে চোখের পলকে পলক রেখে বলল, সত্যি, বুঝতে পারছি না। ভণিতা ভাল লাগছে না। সময় পেলেই উল্টো-পাল্টা চ্যাটিং; আর এখন বুঝতে পারছি না।
কথা শেষে সামিয়ার মুখখানা জুড়ে একটুকরো হাসি ফুটে উঠল। দুজন দুদিকে থেকে আরেকটু কাছাকাছি এড়িয়ে এসে হেলে দুটো মাথা এক করে ঘেঁষে ধরল।
মাস খানিক ধরে সামিয়ার সাথে শামিরের কোনো প্রকার যোগাযোগ হওয়া সম্ভব হয়নি। সামিয়ার সেল নম্বরটাও বন্ধ। ফেসবুকেও সামিয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না। কী ভেবে সামিয়া শামিরকে ব্লক মেরে রেখেছে শামিরের তা অজানা।
হঠাৎ করে একদিন সন্ধ্যাবেলা শামিরের মোবাইলে সামিয়ার কল আসে। সামিয়া বলে, ‘সন্ধ্যের পর আমি রবীন্দ্র সরোবরে থাকব। তুমি এসো।’ শামির তড়িঘড়ি করে মোটরবাইক নিয়ে ছুটে যায়। সামিয়াকে সামনে পেয়ে শামিরের হৃদয় আবেগে উন্মাদপ্রায়। নীল শাড়ী পড়ে দাঁড়িয়ে আছে সামিয়া। শামির দুহাত বাড়িয়ে সামিয়াকে ছুঁতে চায়। সামিয়া বাঁধা দেয়, ‘না শামির, আমাকে স্পর্শ করবে না। আমি আর তোমার নেই।’ সাথে সাথে শামিরের ঘুম ভেঙ্গে যায়। শামির বেড থেকে আঁতকে ওঠে বসে মোবাইলটা হাতে নেয়।
Comments 0