ইসরায়েল ফিলিস্তিনের গাজায় যে হামলা চালাচ্ছে, তাতে দেশটি যুদ্ধাপরাধ করে থাকতে পারে। জাতিসংঘের শীর্ষ মানবাধিকার কর্মকর্তা নাভি পিল্লাই এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
বিশ্বজুড়ে নিন্দা আর যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে গতকাল বুধবারও গাজায় নির্বিচারে বোমা ও ট্যাংকের গোলা ছুড়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। তাদের অভিযানের ১৬তম দিন গতকাল সকাল পর্যন্ত নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা পৌঁছেছে ৬৫০ জনে। খবর এএফপি, বিবিসি ও আল-জাজিরার।
গাজায় ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকটের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে গতকাল সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের (এইচআরসি) এক জরুরি সভায় নাভি পিল্লাই যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত মন্তব্যটি করেন। তিনি এতে বলেন, সামরিক হামলা চালানোর সময় ইসরায়েল বেসামরিক লোকজনকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি। জাতিসংঘের অন্যতম শীর্ষ এই কর্মকর্তা বলেন, ‘দৃশ্যত এ সম্ভাবনা খুব জোরালো যে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে, এমনভাবে যে তা যুদ্ধাপরাধ বলে বিবেচিত হতে পারে।’
নাভি পিল্লাই ইসরায়েলের অভ্যন্তরে গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসের অব্যাহত রকেট হামলারও নিন্দা জানান। ইসরায়েলে হামাসের এই রকেট ছোড়া বন্ধের যুক্তি দিয়েই ৮ জুলাই থেকে গাজার ওপর নতুনভাবে হামলা শুরু করে দেশটি। তবে এ হামলায় হতাহতের মধ্যে হামাসের নেতা-কর্মীর সংখ্যা নগণ্য।
তবে ইসরায়েলের দাবি, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক শীর্ষ পরিষদ এইচআরসি ‘পক্ষপাতদুষ্ট’। জেনেভায় বিবিসির একজন সংবাদদাতা বলেন, ইসরায়েল জাতিসংঘ অনুমোদিত কোনো তদন্ত কার্যক্রমে সহযোগিতা করবে এ রকম সম্ভাবনা কম।
৪৬-জাতির পরিষদ এইচআরসি জাতিসংঘের শীর্ষ মানবাধিকারবিষয়ক ফোরাম। এটি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের ওপর একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত শুরুর আহ্বান জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফিলিস্তিনের তোলা একটি প্রস্তাবের ওপরও ভোটাভুটির জন্য তৈরি হচ্ছে এ পরিষদ। আরব দেশসহ কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রের আহ্বানে এইচআরসি এই জরুরি সভায় বসে।
সভায় তোলা প্রস্তাবটিতে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি অভিযান শুরুর পর থেকে ‘ব্যাপক, পরিকল্পিত ও ঢালাও মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের’ নিন্দা করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে জরুরিভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের আহ্বান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এতে।
সভায় ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রায়াদ মালকি ইসরায়েলের সংঘটিত অপরাধের জন্য দেশটিকে জবাবদিহির সম্মুখীন করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। ক্ষোভ প্রকাশ করে এ সময় তিনি প্রশ্ন করেন, ‘ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আর কত ফিলিস্তিনিকে মরতে হবে?’
অন্যদিকে জাতিসংঘের জেনেভা দপ্তরে নিযুক্ত ইসরায়েলের প্রতিনিধি এভিয়াতার ম্যানর বলেছেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বেসামরিক নাগরিকের হতাহতের সংখ্যা কমাতে অনেক চেষ্টাই করেছে। উল্টো যুদ্ধাপরাধের জন্য হামাসকেই দায়ী করেন তিনি।
এভিয়াতার ম্যানর এইচআরসির বিশেষ অধিবেশন আহ্বানের সমালোচনা করে যুদ্ধবিরতি প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে একে ‘বিপথগামী, অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিপরীত ফলদায়ক’ বলে অভিহিত করেন।
কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় অগ্রগতির দাবি: গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে সহায়তা করতে গতকাল মিসরের কায়রো থেকে ইসরায়েল সফরে যান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। এদিন জেরুজালেমে তিনি বলেন, গাজায় রক্তপাত বন্ধে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় অগ্রগতি হয়েছে। তবে কাঙ্ক্ষিত সফলতা লাভে আরও সময় লাগবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেরি অবশ্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং এর অগ্রগতির ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি। জেরুজালেমে গতকাল দিনের শেষভাগে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং পরে ফিলিস্তিনশাসিত পশ্চিম তীরের রামাল্লায় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠক করার কথা ছিল কেরির। এর আগে কেরি গত সোমবার কায়রোয় জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে গাজা সংকট নিয়ে আলোচনা করেন।
রক্তক্ষয় ও ধ্বংসযজ্ঞ বাড়ছেই: ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা বলেন, ইসরায়েলের হামলায় গতকাল সকাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪৯ জন। ২৪ ঘণ্টা আগেও মৃতের সংখ্যা ছিল ৫৮৩। প্রাণহানির পাশাপাশি আহত মানুষের সংখ্যাও বেড়ে হয়েছে চার হাজার।
অন্যদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, অভিযান শুরুর পর থেকে এ কয়েক দিনে হামাস সদস্যদের সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত হয়েছেন তাদের ২৯ জন সদস্য। নিখোঁজ রয়েছেন এক সেনা। এ সময়ে হামাসের ছোড়া রকেটে প্রাণ হারান আরও দুই বেসামরিক লোক।
মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হওয়া গাজার কয়েকজন বাসিন্দা গতকাল বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী গাজার একটি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে বোমা ফেলেছে। কেন্দ্রটি এ উপত্যকার অর্ধেক অধিবাসীর কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহ করত। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মুখপাত্র বলেন, হামলায় কেন্দ্রের প্রধান যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে গাজার মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।
Comments 1