আরবি শব্দ আশির বা আশ্রুন শব্দ থেকে ‘আশুরা’ উত্পন্ন হয়েছে, যার অর্থ দশম। হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলে। দশ মহররমের সঙ্গে অসংখ্য বরকতময় ঘটনা, প্রিয় পয়গম্বদের প্রতি আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ ও কারবালার বেদনাবিধুর স্মৃতি জড়িত। পবিত্র আশুরার দিবসে আল্লাহ জাল্লা শানু সাগর, পাহাড়, প্রাণিকুল, আসমান-জমিন, লওহ-কলম সৃষ্টি করেছেন, এরশাদ হয়েছে, “তিনি সেই সত্ত্বা যিনি ছয় দিনে আসমান ও জমিনকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আরশের ওপর সমাসীন হয়েছেন” (আল হাদীদ : ৪)। আশুরার দিবসেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। মহরররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ এ চারটি মাসকে আল্লাহপাক পরম সম্মানিত ও পবিত্র বলে আল কোরআনে ঘোষণা করেছেন। নবীজি (স.)-ও এসব মাসকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। হযরত মুহাম্মদ (স.) হিজরতের পর মদিনায় এসে দেখতে পেলেন যে, “ইহুদিরা মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখছে। তারা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে আশুরাও পালন করছে। মহানবী (স.) জানতে পারলেন, তারা হযরত মুসা (আ.)-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য এ দিনকে বেছে নিয়েছে। হুজুর পাক (স.) উপলব্ধি করলেন যে, হযরত মুসা (আ.)-এর প্রতি আমাদেরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই তিনি ওই দিনই রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখতে বললেন” (আবু দাউদ : ২৪৩৬)। নবী করিম (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আশুরার দিনে রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী বছরের সব গুনাহের কাফফারা হয়ে যাবে” (মুসলিম শরিফ : ২৬১৫)। হাদিস শরিফে আরও উল্লেখ রয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরার রাতে খাঁটি অন্তরে নফল নামাজ আদায় করবে, আল্লাহপাক তার সমুদয় গুনাহ মাফ এবং অশেষ রহমত বর্ষণ করবেন। দুনিয়ার যাবতীয় বিপদ-আপদ, রোগ-শোক এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত রাখবেন। রুজি-রোজগার ও আয় উন্নতিতে বরকত দান করবেন। আশুরার দিনে যেসব উল্লেখযোগ্য ও বরকতময় ঘটনা ঘটেছে তার কয়েকটি হল- ১। প্রথম মানব হযরত আদম (আ.) কে আল্লাহ তাঁর খলিফা নিযুক্ত করেন ২। জান্নাত থেকে পৃথিবীতে হযরত আদম ও হাওয়া (আ.) বিচ্ছিন্নভাবে নির্বাসিত হওয়ার পর মক্কার আরাফাত ময়দানে পুনর্মিলিত হন ৩। হযরত নূহ (আ.) মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ করে পৃথিবীকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলেন এই মাসে ৪। হযরত আদম ও হাওয়া (আ.) ৩৯০ বছর আল্লাহর হুজুরে কাঁদার পর নবীজির উসিলায় তাঁদের তওবা কবুল হয় ৫। পৃথিবীর প্রথম হত্যাকান্ড হাবিল-কাবিলের ঘটনা সংঘটিত হয় ৬। হযরত ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকান্ড থেকে উদ্ধার হন ৭। হযরত আইয়ুব (আ.) কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্ত হন ৮। হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে পরিত্রাণ পান ৯। হযরত ইদ্রিস (আ.) কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় পাঠানোর পর গুনাহ-অপরাধের জন্য কান্নাকাটি করলে আল্লাহপাক আবার তাঁকে জান্নাতে ফেরত নেন ১০। হযরত দাউদ (আ.)-এর গুনাহ মাফ হয় ১১। কুমারী মাতা হযরত মরিয়ম (আ.) -এর গর্ভ হতে হযরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন ১২। রহমত স্বরূপ আসমান হতে প্রথম বৃষ্টি নামে ১৩। হযরত সোলাইমান (আ.) হাতের আংটি হারিয়ে সাময়িকভাবে রাজ্যহারা হয়ে আবার আল্লাহ তাঁকে রাজ্য ফিরিয়ে দেন ১৪। হযরত ইউসুফ (আ.) তাঁর পিতা ইয়াকুব (আ.)-এর সঙ্গে সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর সাক্ষাত্ লাভ করেন ১৫। হযরত মুসা (আ.) বাদশা ফেরাউনের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে বনী ইসরাইলকে সঙ্গে নিয়ে নীলনদ পার হয়ে যান, আর নদীর মাঝপথে স্বদলবলে সলিল সমাধি ঘটে ফেরাউনের ১৬। হযরত ঈসা (আ.) কে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে আসমানে তুলে নেন ইত্যাদি। ৬১ হিজরির ১০ মহররম ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) দামেস্কের অধিপতি দুরাচার ইয়াজিদের অসভ্য সেনাবাহিনীর হাতে সপরিবারে শাহাদাতবরণ করলে এ দিনটি মুসলিম উম্মাহর ঘরে ঘরে শোকের দিন হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত বরণে এদিনের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। কারবালার ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রেম-ভালোবাসা ও ত্যাগের ধর্মের মৃত্যু ঘটে পক্ষান্তরে লেবাস ও ভোগের ধর্মের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। ইমাম হোসাইন ছিলেন ত্যাগ ও আল্লাহপ্রেমের প্রতীক আর ইয়াজিদ ছিল লেবাস ও ভোগের পুজারী। কারবালার বর্বরোচিত হত্যাকান্ডে ভীত ও দুঃখ পেয়ে মুহাম্মাদ (স.) এর সিরাজাম মুনিরার ধারক ও বাহক অনুসারি তথা সূফিরা উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তানসহ বহুদেশে সরে যান।
সুত্র: দৈনিক ইত্তেফাক
Comments 1