মরিচ চাষ
মরিচ:
মরিচ বাংলাদেশের একটি প্রধান মসলা, কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশেই ইহা একটি জনপ্রিয় সবজি৷ শীত প্রধান অঞ্চলে সবজি হিসেবে এর ব্যবহার বেশি৷
মরিচ বাংলাদেশের একটি প্রধান মসলা, কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশেই ইহা একটি জনপ্রিয় সবজি৷ শীত প্রধান অঞ্চলে সবজি হিসেবে এর ব্যবহার বেশি৷
পুষ্টিমান
মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হলেও মরিচে পুষ্টির সব উপাদান উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদ্যমান৷ Capsaicin (C18H27O3N) নামক একটি দ্রব্য ঝালের জন্য দায়ী৷ নিচে কাচা ও শুকনা মরিচের পুষ্টিমান দেখানো হলো (প্রতি ১০০ গ্রামে)৷
পুষ্টির উপাদান কাচা মরিচ শুকনা মরিচ
পানি ৮৩-৮৬ গ্রাম ৮-১০ গ্রাম
আমিষ ২-৩ গ্রাম ১৩-১৬ গ্রাম
শ্বেতসার ৬ গ্রাম ৩৩ গ্রাম
আঁশ ৭ গ্রাম ২৫-৩০ গ্রাম
স্নেহ ০.৬ গ্রাম ৬-১১ গ্রাম
ক্যারোটিন ১০০-২০০০০ আ ইউ ২০০-২০০০০ আ ইউ
থয়ামিন ০.০৬ মিলিগ্রাম ০.৬ মিলিগ্রাম
রাইবোফ্লেভিন ০.০৮ মিলিগ্রাম ০.৫ মিলিগ্রাম
নায়াসিন ১.০ মিলিগ্রাম ১২.০ মিলিগ্রাম
ভিটামিন-সি ২৫-২৮০ মিলিগ্রাম নগণ্য মিলিগ্রাম
জাত
বাংলাদেশে মরিচের বহু জাতের চাষ হয়, কিন্তু প্রায় সবই নামহীন৷ অধিকাংশ জাতের ফল সরু ও লম্বা, সবগুলোই জাল৷ কিছু জাতের স্থানীয় নাম আছে৷ এসবের মধ্যে ধানী, বালিঝুরি, নারায়নখোলা, বগুরা, আকাশী,কালো, কমরাঙ্গা, বারোমাসি অন্যতম৷
ধানী মরিচ : ফল খুব ছোট (লম্বায় ১ সে.মি.) ও অত্যাধিক ঝাল৷
কামরাঙ্গা মরিচ : ফল সাদাটে সবুজ, কুচকানো, উপবৃত্তাকার, দৈর্ঘ্যে ৪-৭ সে.মি. সুগন্ধী ও অত্যাধিক ঝাল৷ সিলেটে এই মরিচ নাগা মরিচ নামে পরিচিত৷
জলবায়ু ও মাটি:
মরিচ সব ধরণের মাটিতে চাষ রা যায়৷ তবে সুনিষ্কাসিত বেলে বা পলি দোআঁশ মাটি মরিচ চাষির জন্য উপযোগী৷
চাষাবাদ পদ্ধতি:
জমি তৈরী
৫-৭ চাষ ও মই দিয়ে ভালভাবে জমি তৈরী করতে হবে যেন কোন ঢেলা না থাকে এবং মাটি ঝুরঝুরে হয়৷
বীজ বপন বা চারা উৎপাদন
রবি মৌসুমে ভাদ্র-কাতিᐂক মাস ও খরিপ মৌসুমে মাঘ-বৈশাখ মাস বীজ বপন বা চারা রোপনের জন্য উপযুক্ত সময়৷ সরাসরি বীজ বুনে অথবা চারা রোপণ করে মরিচ চাষ করা যায়৷
সরাসরি বীজ বুনে মরিচ চাষ করলে শতক প্রতি বীজ লাগে ১০-১২ গ্রাম এবং চারা রোপণ পদ্ধতিতে মরিচ চাষ করলে শতক প্রতি বীজ লাগে ২-৩ গ্রাম৷
জাত অনুযায়ী মরিচের গাছের উচ্চতা অনধিক ২৫ সে. মি. থেকে ১০০ সে. মি. পযᐂন্ত হতে পারে৷ এ জন্য বপন ও রোপণের দূরত্ব সে অনুযায়ী নিণᐂয় করতে হবে৷ সাধারণত ছোট আকারের জাত সরাসরি ছিটিয়ে বুনা হয়ে থাকে৷ বৃহদাকার জাতে ৪০-৫০ দিন বয়সের চারা ৬০ সে.মি. দূরত্বে সারি করে সারিতে ২৫-৩০ সে.মি. ব্যবধানে রোপণ করা যেতে পারে৷ বারমাসি জাত আরোও বেশি পাতলা করে লাগাতে হয়৷
ক্ষতিকর পোকা মাকড় দমন:
মরিচ গাছে পোকার আক্রমণ কম হয়৷ মরিচ সাধারণত যেসব পোকা আক্রমণ করে সেসব পোকাগুলো হল
পিঁপড়া
কাটুই পোকা
চওড়া মাকড়
ফল ছিদ্রকারী পোকা
থ্রিপস পোকা
পিঁপড়া
ক্ষতির ধরন
বীজ খেয়ে ক্ষতি করে৷
চারা গাছের বা বড় গাছের শিকড় কেটে গাছের ক্ষতি করে৷
প্রতিকার
প্রতি শতক জমির জন্য ১০০ গ্রাম সেভিন পাউডার পরিমাণমত ছাই এর সাথে মিশিয়ে মাটিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দতে হবে৷
কাটুই পোকা
ক্ষতির ধরন
শুককীট চারা গাছের ক্ষতি করে৷
শুককীট দিনের বেলায় গাছের গোড়ায় বিশ্রাম নেয় এবং রাতে উপরে উঠে চারা গাছের গোড়া কেটে দেয়৷ শুককীট যা খায় তার চেয়ে অনেক বেশী চারা বা গাছের গোড়া কেটে নষ্ট করে৷
প্রতিকার
প্রতিদিন ভোরে কাটা গাছের গোড়ায় মাটি খুঁড়ে শুককীটগুলো মারতে হবে৷
ফসল কাটার পর জমিতে চাষ দিয়ে শুককীট ও মুককীট যদি বের হয়ে যায় তখন হাতে ধরে বা পাখি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷
বিষটোপ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ ১০০ গ্রাম গমের ভূষি আথবা ধানের কুড়া, ১০০ গ্রাম গুড় এবং ২০০ গ্রাম পাদান ৫০০ এস পি সবগুলো একত্রে মিশিয়ে প্রয়োজনীয় পানি দিয়ে মন্ড তৈরী করতে হবে৷সন্ধ্যার পর মন্ড ছিটিয়ে দিলে শুককীট আকষীᐂত হবে এবং এই বিষটোপ খেয়ে মারা যাবে৷
১ মিলিলিটার পরিমাণ সুমিসাইডিন ২০ ইসি বা রিপকডᐂ ১০ ইসি বাসিমবুশ ১০ ইসি ১ লিটার পরিমাণ পানির সাথে মিশিয়ে সন্ধ্যার সময় জমিতে ছিটিয়ে দিলে এই পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷
চওড়া মাকড়
ক্ষতির ধরন
সাধারণত পাতার নীচের দিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷শিরার মধ্যকার এলাকা বাদামী রং ধারণ করে ও শুকিয়ে যায় এবং মারাত্মকভাবে আক্রান্ত পাতা সহজেই ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়৷
কচি পাতা মাকড় দ্বারা আক্রান্ত হলে পাতা নীচের দিকে মুড়ে গিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে সরু হয়ে যায় ৷
chilli_makor_4.jpg
chilli_makor_3.jpg
chilli_makor_1.jpg
ছবি : চওড়া মাকড় আক্রান্ত মরিচ ও পাতা এবং পাতার নিচে মাকড়
ছবি সূত্র : মাঠ নিদেᐂশিকা, এশিয়ান ভেজিটেবল রিসাচᐂ এন্ড ডেভলপমেন্ট সন্টার
প্রতিকার :
জমি সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে৷
ফসল সংগ্রহের পর গাছের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করে ফেলতে হবে৷
২০-৩০ মিলিলিটার মিডক্স বা ক্যালথেন্ড বা ২০ গ্রাম থিয়োভিট ১০ লিটার মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ৷
লাইম সালফার ৭৫০ গ্রাম / একর হারে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়৷
ফল ছিদ্রকারী পোকা
ক্ষতির ধরন
ফলের বৃন্তে একটি ক্ষদ্র আংশিক বদ্ধ কালচে ছিদ্র দেখা যাবে৷
ক্ষতিগ্রস্ত ফলের ভিতরে পোকার বিষ্ঠা ও পচন দেখা যাবে৷
পোকা আক্রান্ত ফল নিধাᐂরিত সময়ের পূবেᐂই পাকে৷
plant.jpg
chilli_fruit_borer_3.jpg
ছবি : ফল ছিদ্রকারী পোকা ও আক্রান্ত মরিচ ছবি সূত্র : মাঠ নিদেᐂশিকা, এশিয়ান ভেজিটেবল রিসাচᐂ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সন্টার
প্রতিকার :
আক্রান্ত পাতা ও ফল সংগ্রহ করে নষ্ট করা
মরিচের জমি গভীর ভাবে চাষ করা ও আগাছা মুক্ত রাখা
চারা রোপণের ১৫দিন পর থেকে প্রতি ৩ দিন পর ক্ষেত পর্যবেক্ষণ করা এবং কীটানশক ব্যবহার না করে আক্রান্ত ডগা ও মরিচদেখা মাত্র তা তুলে ধ্বংস করা
শতকরা ১০ ভাগের বেশি মরিচ এ পোকা দ্বারা আক্রান্ত হলে ডেনিটল ১০ ইসি/ ট্রিবন ১০ ইসি / রিপক ১০ ইসি ১ মি.লি. হারে অথবা ফেনকিল ২০ ইসি .৫ মিলি. হারে অথবা সুমিথিয়ন ৫০ ইসি ২ মি.লি. হারে এগুলোর যে কোন একটি কীটনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে গাছের সমস্ত অংশ ভালভাবে মিশিয়ে স্প্রে করা ৷
থ্রিপস পোকা:
ক্ষতির ধরন
পাতার মধ্যশিরার নিকটবতীᐂ এলাকা বাদামী রঙ ধারণ করে ও শুকিয়ে যায়
নতুন কিংবা পুরাতন পাতার নিচের পিঠে অধিক ক্ষতি হয়
নৌকার খোলের ন্যায় পাতা উপরের দিকে কো৺কড়ে যায়
আক্রান্ত পাতা বিকৃত ও বেঢপ দেখায়
plant_copy.jpg
chilli_thrips_2.jpg
ছবি : পাতায় থ্রিপস পোকা ও থ্রিপস আক্রান্ত গাছ ছবি সূত্র : মাঠ নিদেᐂশিকা, এশিয়ান ভেজিটেবল রিসাচᐂ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সন্টার
প্রতিকার :
১৫ সিসি ম্যালাথিয়ন বা যিথিয়ল বা নগস বা ফাইফানন ১০ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে স্প্র করতে হবে ৷
রোগ দমন:
মরিচ গাছের রোগসমূহ
এনথ্রাকনোজ
ঢলে পড়া
এনথ্রাকনোজ
রোগের লক্ষণ
আক্রান্ত গাছের বাকল প্রথমে বাদামী হয়ে যায় এবং পরে সাদা সাদা ডোরাকাটা দাগের সৃষ্টি হয়৷ রোগের আক্রমণ প্রকট হলে আক্রান্ত ডাল আগা হতে শুরু করে নিচের দিকে শুকিয়ে যায়৷
আক্রান্ত ফুল ঢলে পড়ে ও পড়ে শুকিয়ে ঝরে পড়ে৷
আক্রান্ত মরিচের উপরাংশে বিভিন্ন আকারের কালো কালো দাগ পড়ে এবং পরবর্তীতে বিকৃত হয়ে শুকিয়ে যায়৷
প্রতিকার
৪ চা চামচ ডাইথেন এম-৪৫, ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে৷
ঢলে পড়া
রোগের লক্ষণ
গাছের নিচের পাতাগলো ঝুলে পড়ে৷
কচি ডাল মরে বাদামী রং ধারণ করে৷
আক্রান্ত গাছের শিকর নরম ও ভিজা মনে হয়৷
প্রতিকার
৪ চা চামচ ডাইথেন এম-৪৫, ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে৷
ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
সাধারণত বীজ বপনের ২ মাস পর থেকে কাঁচা মরিচ সংগ্রহ করা যায়৷ বোঁটাসহ মরিচ সংগ্রহ করা উচিত৷ দফায় দফায় পাকা মরিচ সংগ্রহ করে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে৷ শতক প্রতি ৬০ কেজি শুকনো মরিচ অথবা ২৮০ কেজি কাঁচা মরিচ পাওয়া যায়৷
Comments 0